কালক্ষেপণে পোশাক শ্রমিক বিভ্রান্তি ও বিপদে

তাসলিমা আখতার



আতঙ্ক এবং অর্থনীতির মন্দভাব জেঁকে বসেছে সর্বত্র। অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে বিশ্ববাসী। যেন এক বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রবেশে প্রতিদিন পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে নতুন নতুন দিকে। আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভয়-শঙ্কা। খবর আসছে দূরের এবং কাছের মানুষের আক্রান্ত হবার। ‘সতর্কতা ও সচেতনতা’ অভিযানের নামে পুলিশের হাতে উঠেছে লাঠি। পথে আছে সেনাবাহিনী। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি।

দেশে কার্যত চলছে লকডাউন পরিস্থিতি। আইইডিসিআরসহ সরকারি-বেসরকারি সকল প্রচারণায় সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন এবং ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে। মহামারির হাত থেকে বাঁচতে যখন এত সতর্কতা, তখন রপ্তানি আয়ের শীর্ষখাতের ৪১ লাখ পোশাক শ্রমিককে ঘরে ফেরানোর কোন সম্মিলিত ঘোষণা আসেনি সরকার কিংবা মালিকপক্ষ থেকে। ৪ তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি কেবল সরকারি এবং বেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য। একদিকে ২৫ মার্চে প্রধানমন্ত্রীর শিল্পখাতে প্রণোদনা ঘোষণা অন্যদিকে বিজিএমইএর সভাপতির ২৬ মার্চের মালিকদের প্রতি কারখানা বন্ধ রাখার অনুরোধ। কিন্তু যৌথভাবে আসেনি বন্ধের ঘোষণা। ফলে কিছু কারখানা খোলা এবং বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বিভ্রান্তি এবং দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। একদিকে কিছু শ্রমিকের বাড়ি যাবার হিড়িক অন্যদিকে ছুটি ছাড়া বেশির ভাগ শ্রমিকের দুর্ভাবনা। ইতিমধ্যে ৩৮টি কারখানা ১২ ও ১৬ ধারায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে শ্রমিকরা অর্ধেক বেতন ও বাসা ভাড়া পাবেন। যেসব কারখানা খোলা সেখানেও শ্রমিকরা দুশ্চিন্তায় আছেন তারা সময়মতো বেতনটা পাবেন কিনা তা নিয়ে। করোনা কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে তা সম্ভবত সরকার মালিক যৌথভাবে এখনো আঁচ করতে পারেননি। তাই সকল কারখানা বন্ধের ঘোষণা না আসায় হাজার হাজার শ্রমিক বিপদের মুখে এখনো পথে-পরিবহনে-কারখানায়।

২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেবেন এমন আকাঙ্ক্ষা এবং কানাকানি শ্রমিক পাড়াসহ চারপাশে চলছিল। কিন্তু সেই ঘোষণা আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক কর্মচারীর বেতন হিসেবে শিল্পখাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে সবাইকে ভিড় এড়িয়ে চলার কথাও বলেন। এই ‘সবার’ মধ্যে যে শ্রমিকরা নেই সেটা বুঝতে বাকি থাকে না। যেহেতু কারখানা বন্ধ হয়নি সেহেতু ভিড় এড়িয়ে চলবার কোন সুযোগ নেই। প্রতি কর্মদিবসে হাজারে হাজারে শ্রমিককে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ব্যাপক লোকসমাগমে চলতে হয়। শ্রমিকদের একদিকে ভয় জীবনের অন্যদিকে না খেয়ে মরার। বাজারও অনিয়ন্ত্রিত। কেউ কেউ তিন-ছয় মাসের খাবার কিনে মজুদ করছে। কিন্তু শ্রমিকদের সে সামর্থ্য নেই। এছাড়া নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি এমনিতেই তাদের নিত্য সঙ্গী। পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, জ্বর, সর্দি, কাশি, ঠান্ডা, মাথাব্যথা এসমস্ত শ্রমিকদের নিত্য লেগে থাকে। বয়সে তরুণ হলেও তারা চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাদের গড় কর্ম ও জীবনের আয়ুও কম হয় ফলে একটা বয়সের পর তারা কারখানায় কাজের উপযোগী থাকেন না। বড় অংশের বয়স ৪০ এর নীচে। তারপরও সন্দেহ নেই যে তাদের জীবনের ঝুঁকি মধ্যবিত্ত তরুণ স্বাস্থ্যবানদের চেয়ে বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও মধ্যবিত্তের চেয়ে তাদের কম। এছাড়া শ্রমিকদের কেউ কেউ কাজের পরিবেশগত কারণে ভোগেন ফুসফুস, কিডনি ও হার্টের সমস্যায়। শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি, কম ক্যালোরি, কম মজুরির জীবন এবং অনুন্নত পরিবেশে হাজারে হাজারে কাজ করা ইত্যাদি করোনাভাইরাসে সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিবেশ। মালিকদের ব্যবসায়িক বিবেচনা, শিপমেন্ট, লাভালাভের বিবেচনা আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে, বিলম্ব না করে কারখানা বন্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার মালিক এক জায়গায় এসে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে সেটাই আশা করেছিলেন সবাই। কিন্তু এখনো চলছে কালক্ষেপণ ও দোদুল্যমানতা। কিছু কারখানা বন্ধ। তবে বেশির ভাগ খোলা থাকায় ভীতি আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর সবার ধারণায় নতুন চিন্তা আসে। সবাই ভাবে আর বিলম্ব নয় এবার ঘোষণা আসবেই। যেহেতু বেতন দেবার দায়িত্ব সরকার অন্তত প্রথম মাসের জন্য নিয়েছে। তাহলে মালিকদের আর ভয় থাকবে না। সন্ধ্যায় টিভিতে ভেসে ওঠে ‘সাধারণ ছুটির আওতায় ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকল দেশের তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার আহবান বিজিএমইএর। কোন মালিক চাইলে সর্ব্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা রাখতে পারবে। শ্রমিকদের সব দায়িত্ব মালিককে নিতে হবে।’ কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি ছিল বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হকের একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ, বিজিএমইএর নির্দেশনা বা সরকারি ঘোষণা নয়। এই আহ্বান বা অনুরোধ নিশ্চয় ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাবার যোগ্য। দেরি করে হলেও  শ্রমিক কল্যাণে তিনি তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু দঃখজনক হলেও সত্য এখন আহ্বানের চেয়ে প্রয়োজন নির্দেশনা। হাতে সময় একদম নেই। যদি মালিকপক্ষ এক হয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন, তাহলে সরকারকেই সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সময়টা আর যেকোনো সময়ের মতো না। করোনাও হাটি হাটি পা করে এগুচ্ছে না এখন। বিশ্বজুড়ে করোনা ছড়াচ্ছে জ্যামিতিক হারে। করোনা ঠেকানোর প্রাথমিক ধাপগুলো যথাযথভাবে পালন করতে না পারায় এখন তা কমিউনিটি পর্যায় ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশেষ এই পরিস্থিতিতে একদিকে কারখানা বন্ধের আহ্বান অন্যদিকে ‘সব্বোচ্চ নিরাপত্তায়’ কারখানা খোলা রাখার নির্দেশনা। ‘সব্বোচ্চ নিরাপত্তা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে আর কীভাবে সেটা করা হবে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা নেই। কিছু কারখানা বন্ধ হলেও বেশির ভাগ এখনো খোলা। যে কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়েছে সেগুলোর শ্রমিকরা বেতন কীভাবে পাবেন তার কোন সুরাহা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ছাঁটাই না করে, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি হিসাবে কারখানাগুলোতে সরকার এবং বিদেশি ক্রেতা ও মালিক তিন পক্ষের যৌথ দায়িত্বে শ্রমিকদের সবেতন ছুটি দেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে যদি ছুটি দীর্ঘ হয় সেক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ বেতন কার্যকর রাখা দরকার ছুটির সময়ও।

ইতিমধ্যে মালিক শ্রমিক এবং সরকারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে যে বৈঠকে সকল শ্রমিক সংগঠন আমন্ত্রিত ছিল না। সেই বৈঠকেও বন্ধের ঘোষণা আসেনি। মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে নাকি শ্রমিক প্রতিনিধিরাও রাজি হননি কারখানা বন্ধের বিষয়ে। আমরা জানি না সেই প্রতিনিধি কে বা কারা, তবে ধারণা করি,  তারা মালিক এবং সরকারের সঙ্গে ঘেঁষে থাকা কেউ তাই তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় থেকে বৈঠক ডাকলে আমাদের সংগঠন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি এবং শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের জোট থেকে আমি, শবনম হাফিজ, রাজু আহমেদ ও জুলহাস নাইনসহ চার জন উপস্থিত হই। যেখানে ২০ জনের বেশি শ্রমিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। সেইখানে লিখিতভাবে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর কাছে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক অধিকার আন্দোলন থেকে পাঁচ দফা দাবিসহ কারখানা বন্ধের দাবি জানাই। তার আগেই গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি, গার্মেন্ট টিইউসি, গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, শ্রমিক অধিকার আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের কারখানা বন্ধের ঘোষণা চেয়ে বিবৃতি ২১ ও ২২ মার্চ পত্রিকায় ছাপা হয়। অথচ এতো কিছুর পরও কারখানা বন্ধ দেয়া হয়নি। এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে মালিক এবং সরকার দুইয়ের সিদ্ধান্তহীনতা এবং কালক্ষেপণের কারণে শ্রমিকরা সব মিলিয়ে বিরাট দুর্ভোগে পড়তে যাচ্ছেন। মালিকদের ঐক্যমত্যে না পৌঁছানো এবং সরকারের দ্বিমুখী নীতির সমস্ত কিছু দুরে ঠেলে আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তির জীবন বাঁচাতে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে জরুরি ভিত্তিতে আংশিক নয় সকল শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

এইসব পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়েছে এই খাতে আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট। ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক ব্র্যান্ড তাদের অর্ডারের পরিমাণ কমাচ্ছে, কোথাও কোথাও বাতিল করছে। ৯৫৯ কারখানার ৮২ কোটি ৬৪ লাখ পিস কাপড়ের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এতে ২৬৭ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই সময়ে কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রামিত হলে ভবিষ্যতে রপ্তানি আয়ের শীর্ষে থাকা এই খাত আরও হুমকি ও বিপদের মধ্যে পড়বে। করোনা শ্রমিকদের মধ্যে ছড়ালে বায়াররা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে অর্ডার দেওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত হবে, যা অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। আপাতত বিশেষ অবস্থায় কারখানা বন্ধ রাখলে সাময়িকভাবে অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হলেও ভবিষ্যতের বিপদ দূর হবে। আর এই সাময়িক চাপ দূর করতে সরকারকে এই খাতে প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ঋণ, আর্থিক সহায়তা ও সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান করা জরুরি। সরকার বা  মালিকপক্ষ দোদুল্যমান না থেকে দ্রুত কারখানা বন্ধ করা এই সময়ের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ। বিদেশি ক্রেতা যারা এই খাত থেকে সিংহভাগ লভ্যাংশ নিয়ে যায় তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে সরকার এবং মালিকপক্ষকে। দেশের শ্রমিকদের জীবন জীবিকা এবং নিরাপত্তার দায় গ্রহণ করতে হবে তিন পক্ষকেই।

শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের চেষ্টা করতে হবে। বলা সহজ হলেও জানা কথা, শ্রমজীবী মানুষ যে জীবন যাপন করে চাইলেও তাদের বাস্তব সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থায়ই তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায় যে কোন স্বাভাবিক সময়েই। আর এটাতো বিশেষ আপৎকালীন সময়। এই সময়ে মালিক, ক্রেতাদের পাশাপাশি সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদেরও যৌথভাবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার জন্য প্রচারণা, সহায়তা যতদূর সম্ভব করে যেতে হবে। পিপিই যদি শ্রমিক সংগঠকদেরও প্রদান করা হয় তাহলে তারাও ঘরের বাইরে এসে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবাসহ নানারকম সচেতনতা মূলক কাজে বর্তমানের চেয়ে আরও বেশিমাত্রায় যুক্ত হতে পারে। সেই বিষয়ে সরকারসহ মালিক বায়ার সবাই সজাগ থাকবে সেই কামনা করতে পারি। আর সবশেষে শ্রমিক বন্ধু-বোন-ভাই সকলকে সাবধান থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা বলতে চাই। শ্রমিক এলাকায় সামাজিক উদ্যোগে সবাই স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে চলবে সংক্রমণ এড়াতে সেটা সকল শ্রমিকদের প্রতি চাওয়া।


তাসলিমা আখতার
সভাপ্রধান গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রী
taslima_74@yahoo.com






------------
প্রকাশিত হয়েছে:
দ্যা ডেইলি স্টার
শনিবার, মার্চ ২৮, ২০২০ 

https://bangla.thedailystar.net/node/141310